মির্জা মাইনুল হোসেন সখেদে পায়চারি করছেন লিভিংরুম টু বেডরুম, বেডরুম টু ব্যালকনি; হাত দুটি পিছনে, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। চোখ-মুখ ফোঁসফোঁস করছে কিন্তু কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। কখনও রাগের মাত্রা বেড়ে গেলে ব্যালকনিতে লাগানো মানিপ্ল্যান্টের পাশে দণ্ডায়মান আকাশ পর্যবেক্ষণরত নাতনি শোভার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে এক মহুর্ত থামছেনও।
বাবা-মা জানিয়ে দিয়েছেন, হবে না। যত বড় চিন্তক ও ভাবুক হোক না কেন, এই ছেলে অর্থাৎ শফি হচ্ছে গুড ফর নাথিং; মেয়ে একটু বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন হলে এই ছেলের জন্য এত আকুল হত না। তবে শোভার শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে দাদু; এই বিপত্নীক বুড়োকে সে খুব সহজেই দুর্বল করে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রেও সে অনেকটা সফলকাম হয়েছে বলা যায় এজন্য যে দাদু তাঁর ছেলে আর বৌমাকে সিগনাল দিয়েছেন, ‘ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি একটু নেড়েচেড়ে দেখি।’
তো দাদু শোভার কাছ থেকে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যা জেনেছেন তার সংক্ষিপ্তসার হল এই যে, ছেলেটি মা-হারা; বাপ থেকেও কাছে নেই – ডিপ্লোম্যাট, ইউরোপের কোন এক দেশে ইকোনোমিক কাউন্সেলর হিসেবে আছেন। তিন বছর আগে শফির মা ক্যান্সারে মারা গেলে একমাত্র বোনকে আরেক সরকারি কর্মকর্তার কাছে সম্প্রদান করে বাবা মোটামুটি হালকা হয়ে তাঁর কর্মস্থলে চলে গেছেন। তবে বছরে অন্তত একবার তিনি দেশে আসেন মূলত তাঁর মায়ের টানে। ছেলেমেয়েকে দেশে পড়াশোনা করাবেন বলে দূতাবাসের তিনটি পোস্টিং-এর কোথাও স্থায়ীভাবে পরিবার নিয়ে যাননি। কিছুদিনের জন্য স্ত্রীকে কর্মস্থলে রেখে দিলেও ছেলেমেয়েরা ক’দিন থেকেই দেশে চলে আসত। আর দেশেতো তাদের দাদী আছেনই; সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু ভদ্রলোকের পত্নীবিয়োগ এবং মেয়ের বিয়ে এ দুটি ঘটনা দ্রুত ঘটে যাওয়ায় বুড়ো মা অর্থাৎ শফির দাদী যেন আরোও বুড়ো হয়ে গেছেন। শফির বাবা আশা করেছিলেন, ছেলেটা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে; কিন্তু তা না করে সে যতসব আজগুবি ভাবনার কুণ্ডুলি মাথায় পাকিয়ে বসে রয়েছে।
শোভা অনেকটা অপরাধীর মত আঁড়চোখে দাদুর পায়চারি দেখে। শোভাই শফির দাদীর কাছে ফোন করতে রাজি করিয়েছিল দাদুকে। উদ্দেশ্য, ভাব জমানো। দুই দিককার বুড়োবুড়ি কথাবার্তা বলে একটু বোঝাপড়ায় চলে এলে ব্যাপারটা সহজ হবে এটাই আশা করেছিল শোভা। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সালাম বিনিময়ের পর শোভার দাদুই ভুল চাল দিয়ে বসেন। তিনি বলেন, ‘শুনলাম আপনার নাতি নাকি আমার নাতনির পিছু ছাড়ছে না।’ ব্যস, এতেই হয়ে যায়। সাথে সাথে শফির দাদীর চান্দি গরম হয়ে গেলে তিনি জবাব দেন, ‘শুনুন জনাব, একটু শালীনভাবে কথা বলুন। আমার নাতির জন্য কি রাজকন্যার অভাব পড়েছে যে আপনার নাতনির পিছু পিছু ঘুরবে? আপনার নাতনিইতো জোঁকের মত কামড় দিয়ে বসে আছে।’
আবহাওয়া গরম হয়ে উঠলেও হুট করে কেউ লাইন কেটে দেননি। ফুটানি যার যতটুকু আছে দেখিয়েই গেছেন । শোভার দাদু যে সুপ্রীম কোর্টের একজন ডাকসাইটে উকিল ছিলেন একথা বেশ দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেছেন। একই ভাবে শফির দাদীও জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর স্বামীর অকালমৃত্যু না হলে তিনি সচিব হয়েই অনেক আগে রিটায়ার করতেন। কথা কাটাকাটি অনেকক্ষণ হলেও মূল বিষয়ে কিন্তু কেউই স্থির হতে পারেননি। শফির দাদী শেষ কথাটা বলে শোভার দাদূর মেজাজ আরেকটু চড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনি ডাক্তারের কাছে যান উকিল সাহেব; মনে হচ্ছে আপনার তবিয়ত খুব ভাল নয়। পরে একদিন কথা বলা যাবে।’ এর পর থেকেই গজগজ করতে করতে পায়চারি করছেন অ্যাডভোকেট মির্জা মাইনুল হোসেন।
দৈনিক আলোকিত দিনের সম্পাদকের অফিসের আড্ডায় শফির সাম্প্রতিক ফিচার নিয়ে মোটামুটি একটা বিতর্ক জমে উঠেছে। একজন জাঁদরেল কলামিস্ট ছাড়াও আরও দুজন সিনিয়র সাংবাদিক উপস্থিত সেখানে। শফি তার সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা পিটিয়ে চলে যাবার মুহুর্তেই হঠাৎ সম্পাদকের সামনে পড়ে গেলে তিনি তাকে টেনে নিয়ে আসেন তাঁর রুমে। বন্ধুদের সৌজন্যে সম্পাদকের সাথে শফির ভাল সখ্য। সম্পাদক বললেন, ‘এই যে পণ্ডিত, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি কি ব্রেনড্রেনকে উৎসাহিত করতে চাও? এই যে, প্রফেসর সাহেবই কথাটা বলছিলেন একটু আগে। তুমি চেনো ওনাকে?’
শফির বুঝতে বাকি রইল না সম্পাদক সাহেব তার ফিচার নিয়ে কথা বলছেন। প্রফেসর সাহেব এ পত্রিকায় অর্থনীতি, সমাজনীতি নিয়ে কলাম লেখেন; সে তাঁকে ভালভাবে চেনে। সে বলে, ‘স্যারকে আমি ভাল করেই চিনি।’
শফি একটা খালি চেয়ারে বসে পড়লে তার দিকে তাকিয়ে প্রফেসর সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, এই অল্প লেখাপড়া জানা অচেনা ট্যালেন্টেড ছেলেগুলোকে আপনি বিদেশে চলে যেতে উৎসাহ দেবার পেছনে যুক্তি কী?
শফি একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘স্যার, ক্ষমা করবেন। আপনি কি মনে করেন, এই প্রতিভাগুলোর আমরা মূল্যায়ন করতে পারব? একটু পিছন দিকে তাকালে দেখতে পাবেন গত এক দশকে চমক লাগানো আবিষ্কার নিয়ে অনেকগুলো তরুনের আবির্ভাব ঘটেছে; জ্বালানীবিহীন বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ি চালানো; কৃষি যন্ত্রপাতি, ফল-ফসলের উদ্ভাবন, আরোও কত কি তারা করেছে। কিন্তু এখন তারা কোথায় আছে? নেই। তারা দাঁড়াতে পারেনি, কিংবা দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। তারা হারিয়ে গেছে। কিন্তু ওরা যদি উন্নত দেশে জন্মাত, তবে আজ তাদের অবস্থান কোথায় থাকত স্যার ?’
সম্পাদক বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু তোমার কথা হল ওরা যখন দেশে কদর পাচ্ছে না তাই অন্য দেশে চলে যাক, যেখানে তাদের পৃষ্টপোষক পাওয়া যাবে; তাইতো? তুমি কি মনে কর ব্যাপারটা এত সহজ?’
‘না, সহজ নয়। ’ শফি বলে, ‘আবার কঠিনও নয়। ওদের শুধু রাস্তায় তুলে দিতে হবে। কিন্তু এই কাজটা যাদের জন্য সহজ তারা ভ্রুক্ষেপই করছে না। তাই আমি পণ করেছি, আমি কিছু করব। শুধু গতানুগতিক লেখালেখিই নয়; আমি আসল কাজে নেমে পড়েছি।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ প্রফেসর সাহেবকে উৎসুক দেখা গেল।
‘আমি একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। কয়েকটি ছেলের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তাছাড়া কয়েকটি বিদেশি সংস্থার সাথেও আমি যোগাযোগ করেছি এবং সাড়াও পেয়েছি। ’ কথাগুলো বলতে বলতে শফির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
উপস্থিত দুজন সাংবাদিকের একজন তখন কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময় শফির ফোন বেজে ওঠে। সে তখন কাউকে ‘ঠিক আছে, এক্ষুনি আসছি’ বলে উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে বলে, ‘আমি আপনাদের সাথে আবার বসব।’
শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করছিল শোভা। শফি এসেই বলল, ‘চল, কিছু খাই আগে, আমার খিদে পেয়েছে। ’
দুপুর গড়িয়ে গেছে। শোভাও কিছু খেয়ে আসেনি। তাই সেও অন্য কিছু না বলে শফির সাথে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল।
তেহারির প্যাকেট আর কোল্ডড্রিংক্স নিয়ে ফুটপাতে গাছের নিচে বসে খেতে খেতে বুড়োবুড়ির সকালের ফোনালাপের ফিরিস্তি দিল শোভা। এতে শফির মুখে উদ্বেগের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। বরং সে শোভার কথা শুনে ক্যাবলাকান্ত মুখ করে মুচকি হাসল।
শফির এ স্বভাব শোভা চেনে। সে এমনই; সবকিছুই তার কাছে পান্তা-সরল। তবুও শোভা কপট ধমকাল, ‘তারপরও তুমি আঁতেলের মত হাসছ? যেন ব্যাপারটা কিছুই না?’
শফি আঁতেলের মতই বলল, ‘ডোন্ট এন্টারটেইন এনি প্রবলেম। সব ঠিক হয়ে যাবে; আমি বুড়ির দায়িত্ব নিলাম, তুমি বুড়োকে সামলাও।’
‘মানে?’
‘মানে আর কিছু না, ওরা দুজন বেঁকে আছে, ওদের আবার টেনেহিঁচড়ে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে হবে।’ শফির জ্ঞানগর্ভ উত্তর।
ইতিমধ্যে টন টন কাঠখড় পুড়ানো হয়েছে। শফি হায়ার করেছে এক বন্ধুকে; আর শোভা নিয়ে এসেছে একজোড়া ডানাকাটা পরী। দুই ফ্রন্টে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যারপরনাই চেষ্টা চলছে দুই কুশীলবকে বাগে এনে একটা সন্ধির আবহ তৈরি করার। সপ্তাহখানেকের প্রানান্তকর চেষ্টার পর মোটামুটি একটা সম্মানজনক সমাধান বেরিয়ে আসে। অ্যাডভোকেট হোসেন পরিস্কার বলে দিয়েছেন, ফোনে আর কোনো কথা হবে না, বরপক্ষকে প্রথামত প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে। তারপর অন্যকথা।
ইউনেস্কো অফিসে গুরুত্ত্বপূর্ন সভা ছিল শফির । দুইটা ছেলে – যারা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে অটোরিক্সা চালাতে সক্ষম হয়েছে – তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। শফির মনটা তাই ফুরফুরে। বিদেশে গেলে ছেলেগুলোর কপাল খুলে যেতে পারে। যাক, লক্ষণ ভাল মনে হচ্ছে। সভা শেষ করেই দাদীকে ফোন দিয়ে জানতে চায় ওরা কি রওয়ানা দিয়েছে। দাদী বললেন, ‘তুই বাসায় না এসে সোজা শোভাদের ওখানে চলে যা; আমি তোর বড়মামাকে নিয়ে এখুনি বেরুচ্ছি। ’
রাইডার মটরসাইকেল থেকে নেমেই শোভাকে ফোন করে শফি, ‘আমার দাদী এসেছে?’
শোভা দাদুর সাথেই কথা বলছিল। শফির ফোন ধরেই সে এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল, কীভাবে কথা বলবে। আমতা আমতা করছিল দেখে দাদু একটা ধমক লাগালেন, ‘ মিনমিন করে কার সাথে কথা বলছিস?’
শোভা গলা নামিয়ে বলল, ‘ওরা এখনও এসে পৌঁছায়নি, কিন্তু শফি অফিস থেকে আগেই এসে পড়েছে...’
‘এসেই পড়েছে যখন, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? ভেতরে আসতে বল।’
দাদুর অনুমতি পেয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল শোভা। সে দ্রুত দাদুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এবং মিনিটদুয়েক পরে শফিকে নিয়ে ফিরে এল।
শফি সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে অ্যাডভোকেট হোসেন সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ উল্টিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।’
শফি নিরেট ভদ্রলোকের মত বসে পড়লে উল্টাদিকের সোফায় শোভার দাদুও বসে পড়েন। ঠিক তখনই আরেকটি ফোন এলে শোভা কল রিসিভ করতে করতে অন্য রুমে চলে যায়। এতে শফির অবয়বে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।
দাদু তখন তীর্যকভাবে বললেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি দার্শনিক; কাজকর্ম খাওয়াদাওয়ার কোনো চিন্তা নেই; আবার বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছ। তুমি নাহয় না খেয়ে থাকলে, বিয়ে করলে বউকে খাওয়াবে কী?
শফি তার স্বভাবজাত মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘দাদু, মানুষ শুধুই খাওয়া-পরা নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক মহৎ বৃহৎ চিন্তার বিষয় পড়ে রয়েছে; ওগুলো নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। আমি দার্শনিক নই, তবে প্রতিশ্রুতিশীল মানুষের জন্য কিছু একটা করতে চাই।’
‘বাহ, ভারি ওজনদার কথাতো! তোমার কি ধারণা আছে, তুমি কোন সমাজে বসবাস করছ?’
শফি বলল, ‘দাদু, আপনি যা বলছেন আমি বুঝতে পারছি। কেউ যদি এগিয়ে না আসে তবে সমাজতো আরোও রসাতলে যাবে। আমি মনে করি সমাজের প্রতি আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে...’
শফির কথা থামিয়ে দিয়ে দাদু হাত তুলে বললেন, ‘ইয়াংম্যান, তোমার বয়স আমিও পেরিয়ে এসেছি; এই বয়সে সবাই নায়ক হতে চায়। কিন্তু পথ চলতে চলতে একসময় দেখবে পায়ের নিচের মাটি আর মসৃণ নেই, কঠিন কঙ্করময়। এটাই সমাজের চ্যালেঞ্জ। শোনো, আমি কোনো ইউটোপিয়ান সমাজসংস্কারকের হাতে আমার নাতনিকে তুলে দিতে পারি না। সে গর্দভ না হলে এই ডিসিশনটা সে-ই দিতে পারত। ’
সে মুহুর্তে হন্তদন্ত হয়ে শোভা এসে জানাল, ‘দাদু, মেহমানরা এসে গেছেন।’
‘এসে গেছেন, ভাল। নিয়ে এস। কিন্তু এই স্বপ্নবাজের সাথে তোমার বিয়ে হতে পারে না।’ দাদু এমনভাবে কথাটা বললেন যেন এটাই তাঁর পাকা সিদ্ধান্ত।
শোভা ফিসফিস করে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, একটু আস্তে কথা বল। মেহমানরা এসে পড়েছেন, ওঁদের রিসিভ কর আগে।’
শোভার কথা শেষ হবার আগেই অভিজাত বেশে সত্তরোর্ধ একজন সুশীলা নারী, ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর পিছনে অত্যন্ত সুবেশী প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক।
অ্যাডভোকেট হোসেন সাহেব খানিক আগে কিছুটা উত্তেজিত থাকলেও কেতার সম্পূর্ণ সদব্যবহার করেই মেহমানদের আমন্ত্রণ জানালেন, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আসুন আসুন, প্লিজ বসুন।’
শফি ইতিমধ্যে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার দাদী সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘উকিল সাহেবের সাথে আজ প্রথম দেখা। কি সৌভাগ্য! আপনার বাড়িতে আসতে পেরে খুব ভাল লাগছে। ’
শোভার দাদু বললেন, ‘ইটস মাই প্লেজার। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম!
এই বয়সেও শফির দাদীর চুল সবকটি সাদা হয়ে যায়নি। সাস্থ্যও অন্য দশজনের চেয়ে বেশ ভাল। আচরণে কৌলীন্যের ছাপ। তাঁকে দেখেই উকিল সাহেবের মনে হালকা অপরাধবোধ জেগে উঠেছে। এমন ভদ্রমহিলার সাথেই কিনা তিনি সেদিন যাচ্ছেতাইভাবে কথা বলেছেন। আজকের বিয়ের আলাপ হয়ত সফল নাও হতে পারে । তবে তিনি তার সেদিনকার ত্রুটিটুকু কাটাকাটি করার তাগিদ অনুভব করলেন।
শোভার বাবা-মা এসে পরিচিত হবার আগেই মিষ্টান্ন, শরবত এসে পড়েছে। দাদু মেহমানদের তোয়াজ করতে করতে গুছিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পর শোভার উদ্দেশে ডাক পাড়লেন, ‘কিরে তোর বাবা-মা কোথায়? ওদের আসতে বল।’
শফি নিজে সবাইকে নাশতা এগিয়ে দিতে দিতে অ্যাডভোকেট সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদু আপনাকে কোনটা দেব?’
দাদু তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ হয়েই কেমন একটু ভাবালু হয়ে পড়েছেন। শফির দিকে একটু কটমট করে তাকালেন বটে। কিন্তু তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে তিনি তার দাদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার শ্বশুরবাড়ি মুন্সীগঞ্জ শুনেছি। কিছু মনে করবেন না; সিলেটের সাথে আপনার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ আছে কি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি উকিল সাহেব। আমার কথার মধ্যে সিলেটের গন্ধ পাচ্ছেন। আমার বাবার বাড়ি ঠিক সিলেট নয় অবশ্য, রাজনগর; মৌলভীবাজারের রাজনগর। ’
অ্যাডভোকেট সাহেব শফির দাদীর কথা শেষ হতে না হতেই নিজের আসন থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ বিস্ফোরিত করে উচ্চারণ করলেন, ‘রাজনগর!’
‘জ্বী হাঁ; আপনি কি গেছেন কখনও রাজনগর? আমি সেখানকার খলাগাঁও করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি। তারপর হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। হা হা হা। ’
অ্যাডভোকেট সাহেব আবার স্ব-আসনে চুপ করে বসে পড়েন। জাঁদরেল উকিল সাহেবকে কোর্টের সাক্ষীর মত কেমন ভ্যাবাচ্যাকা লাগছে। তাঁর ডায়াবেটিস আছে বলে মিষ্টিজাতীয় কিছু খান না। কিন্তু শফির দাদীর কথা শুনে ডায়াবেটিসের কথা ভুলে গিয়ে গ্লাসের শরবত সবটুকু তিনি এক ঢোকে গিলে ফেলেন। তারপর ডানহাতের কম্পমান তর্জনী শফির দাদীর দিকে নির্দেশ করে তোতলাতে তোতলাতে বলেন, ‘র-রহিমা...’
‘হ্যাঁ, রহিমা, আমার নাম রহিমা; আপনি জানলেন কীভাবে?’ বলে, শফির দাদী তাঁর চশমার গ্লাস দ্রুততার সাথে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে আবার পরলেন।
শোভার দাদু উত্তেজনায় একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে এবার তিনি বলে উঠেন, ‘তুমি রহিমা!... কী আশ্চর্য! আমি বাবুল...ঐযে স্পোর্টসে...’
উকিল সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই শোভার বাবা-মা রুমে ঢুকেই অতিথিদের সালাম দেন। শফির দাদী অর্থাৎ রহিমা যখন পুরোপুরি স্থিত হয়ে তাদের সালামের উত্তর দিয়ে কুশল বিনিময় করতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখন উকিল সাহেব সেখানে বিঘ্ন ঘটিয়ে বসেন। তিনি তাঁর ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে হড়হড় করে বলেন, ‘এক কাজ কর, এখানে আর আলাপ-আলোচনার কিছু নেই। তোমরা বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেল।’